রবিবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮:১২ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

শুধু জনগণেরই কোনো সিন্ডিকেট নেই

সৈয়দ ফায়েজ আহমেদ:
কক্সবাজার নিয়ে বাংলাদেশিদের গর্বের শেষ নেই। এর সমুদ্র সৈকত বাংলাদেশের নান্দনিকতার প্রতীক যেন। বাংলাদেশের জন্মের পর থেকেই দেশের পরিচয় করিয়ে দেওয়া ক্যালেন্ডার হোক কিংবা অন্য কোনো ধরনের স্মরণিকা, তাতে সবচেয়ে বেশিবার উল্লিখিত স্থানের একটি কক্সবাজার। বিদেশি কিংবা দেশি পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু এই নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার।

অবশ্য এর মূল্যও চুকাতে হচ্ছে কক্সবাজারকে। সৈকতের শহরটি অতিরিক্ত পরিমাণে হোটেল আর স্থাপনার চাপে পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্মুখীন। মূল সৈকত এখন অনেকের কাছেই আবেদন হারিয়েছে। তবে, এত কিছুর পরেও দীর্ঘদিন কক্সবাজারের যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল অপ্রতুল। বহুদিন ধরে এই জনপদের মানুষ একটি ট্রেন সেবার দাবি করে আসছিলেন। বিশেষত চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের সড়কপথের অবস্থা বেশ বেহাল। এই পথের অবস্থা এবং বেসরকারি বাস সেবাগুলোর উন্নাসিকতা ও অব্যবস্থাপনায় পর্যটক ও স্থানীরা অনেকদিন ধরেই একটি রেলপথের দাবি করে আসছিলেন। বহু বছরের সেই দাবি অবশেষে পূরণ হয়। চট্টগ্রাম থেকে রেললাইন ও কক্সবাজারে একটি স্টেশন নির্মাণ সম্পন্ন হয় গত বছরের শেষ দিকে।

গত বছর ১১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নতুন রেললাইনটির উদ্বোধনের পর ১ ডিসেম্বর থেকে ঢাকা-কক্সাবাজার রুটে ট্রেন চলাচল শুরু হয়, যেটির নাম রাখা হয় কক্সাবাজার এক্সপ্রেস। চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত নির্মিত ১০২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে রেললাইন নির্মাণে খরচ হয় ১৮ হাজার কোটি টাকা। স্টেশনটির নান্দনিক সৌন্দর্য নিয়ে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বিপুল প্রশংসা করা হয়। বলা হতে থাকে, সৈকত শহরটির আরও একটি দর্শনীয় স্থান হতে চলেছে খোদ স্টেশনটিই।

পরের মাসেই ঢাকা থেকে একই রুটে পর্যটক এক্সপ্রেস নামের আরও একটি ট্রেন চালু করা হয়। দুটি ট্রেনই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কিন্তু, আশ্চর্যজনকভাবে, হাজার হাজার কোটি টাকা দিয়ে লাইন নির্মিত হলেও শুধুমাত্র চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার যাতায়াতের কোনো পৃথক ট্রেন চালু করা হয়নি। জনগণের দাবির মুখে এপ্রিল মাসের শুরুর দিকে ঈদুল ফিতর উপলক্ষে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে ‘কক্সবাজার স্পেশাল’ নামে একটি বিশেষ ট্রেন চালু করে রেলওয়ে কর্র্তৃপক্ষ।

‘ঈদ স্পেশাল’ এই ট্রেনটি ঈদের আগে পাঁচ দিন ও পরে পাঁচ দিন মিলিয়ে মোট ১০ দিন চালুর পরিকল্পনা থাকলেও পরবর্তী সময়ে যাত্রীদের চাহিদা ও রেলওয়ের সক্ষমতা বিবেচনায় রেখে দফায় দফায় এই ট্রেন চালু রাখার মেয়াদ বাড়ানো হয় এবং অন্তত জুনের ১০ তারিখ পর্যন্ত ট্রেন সেবাটি চালু থাকবে বলে জানানো হয়।

এই সেবাটি খুবই জনপ্রিয় হয় এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষ ট্রেনটি স্থায়ী করাসহ এই রুটে নতুন আরও একটি ট্রেন চালুর জন্য রেল কর্র্তৃপক্ষকে মে মাসে স্মারক প্রদান করে চট্টগ্রাম-দোহাজারী-কক্সবাজার রেলওয়ে যাত্রী কল্যাণ পরিষদ। তবে, সেই দাবি মানা তো দূরের কথা, মে মাসের ৩০ তারিখ হুট করেই রেল সেবাটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।

রেল কর্র্তৃপক্ষ এর কারণ হিসেবে ইঞ্জিন ও চালকের সংকটের কথা উল্লেখ করলেও জনমনে এই নিয়ে সন্দেহ দানা বাঁধে। যাত্রী অধিকার নিয়ে কাজ করা বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি সরাসরিই অভিযোগ জানায় যে, বাস মালিকদের সুবিধা করে দিতেই এই ট্রেন বন্ধের ঘোষণা এলো। পুনরায় এই ট্রেন চালু না হলে, যাত্রী সাধারণকে নিয়ে বৃহত্তর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দেন সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী।

গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে জনাব চৌধুরী দাবি করেন, ‘চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে যাত্রীরা যখন এই ট্রেনে নিয়মিত যাতায়াত করছিলেন, তখন যাত্রী সংকটে বাস মালিকরা চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে যাত্রীপ্রতি বাস ভাড়া ১০০ টাকা পর্যন্ত কমিয়ে আনতে বাধ্য হন। তারপরেও বাসে যাত্রী না পাওয়ায় বাস মালিকরা রেল প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্র্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে ফেলেছে বলে এই রুটে যাত্রীদের অনেকেই মনে করেন। তাই বাস মালিকদের প্রেসক্রিপশনে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটের জনপ্রিয় ট্রেন সার্ভিস কক্সবাজার স্পেশাল ট্রেন বন্ধ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।’

অবশ্য এর পরের দিনই রেল কর্র্তৃপক্ষ জানায় যে ঈদ উপলক্ষে ১২ জুন থেকে বিশেষ ট্রেনটি আবার চালু করা হবে; তবে তা ১০-১২ দিন পর বন্ধ হয়ে যাবে। সাধারণ যাত্রীরা তো বটেই, রেলপথের বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, লোকবল বা ইঞ্জিন সংকটের ব্যাপারটা পুরোপুরি বিশ্বাসযোগ্য না।

বাংলাদেশের মতো জনঘনত্বের দেশে রেলসেবা বিপুল জনপ্রিয় হলেও বছরের পর বছর এই সেবায় সরকার লোকসান দিয়েই যাচ্ছে। গত এক যুগের বেশি সময়ে লোকসান ছাড়িয়েছে ১৭ হাজার কোটি টাকা। কেবল গত অর্থবছরেই লোকসান হয়েছে ২৪০০ কোটি টাকা। রেলকে লাভজনক করার চেষ্টায় গত ১৮ বছরে প্রায় ৯৪ হাজার কোটি টাকা উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে আরও প্রায় দুই লাখ কোটি টাকার প্রকল্প চালু আছে।

এত কিছুর পরেও যদি জনতা অন্তত সেবা পেত তবে তা হয়তো সরকারের ভর্তুকি হিসেবেও চালিয়ে দেওয়া যেতে পারত, দিন শেষে সরকারের টাকা মানে তো জনগণের উপার্জিত করের টাকাই। কিন্তু, এই দেশের জনগণের এতই দুর্ভাগ্য যে, বিপুল টাকা তো খরচ হয়ই, উল্টো তার ভোগান্তি বাড়ে।

হাজার হাজার কোটি টাকা খরচের পরেও জণগণকে শুনতে হয় যে, উপযুক্ত পরিমাণে ইঞ্জিন বা লোকবল নেই। রেলের টিকিট সোনার হরিণ হলেও দেখা যায় যে, রেলের লোকসানই বাড়ছে। বছরে বছরে টিকিটের মূল্য বাড়ালেও এই লোকসান কোনোভাবেই কমছে না। অর্থাৎ, সব দিক দিয়েই ক্ষতিটা জনগণেরই।

এর কারণ অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে, এই দেশে যারা নীতিনির্ধারক তারা জনতাকে কখনো সেই গুরুত্বই দেন না। তাদের দাবি-দাওয়ার চেয়ে এইসব প্রকল্পে কীভাবে টুপাইস কামানো যায় সেইসবই মূল উদ্দেশ্য হয়। আর যেহেতু, জবাবদিহি নেই, এইসব দুর্নীতি কদাচিৎ ধরা পড়ে। ক্ষমতাশালীরাই দুর্নীতির সিন্ডিকেট করে।

হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে রেললাইন ও স্টেশন নির্মাণ করা হলেও, যথেষ্ট পরিমাণে ইঞ্জিন ও লোকবল নেই এই অজুহাতটাই রীতিমতো অবিশ্বাস্য। স্বাভাবিক বিচার বলে, আগে এইসব নিশ্চিত করে অথবা নিদেনপক্ষে প্রকল্পের অংশ হিসেবে কাজগুলো করা দরকার। এত বড় প্রকল্পের আগে নিশ্চিতভাবেই জরিপ করা দরকার এই লাইনে কয়টা ট্রেন চলবে এবং সেগুলো চালানোর জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা প্রস্তুত রাখা। বাংলাদেশের মতো বিপুল জনসংখ্যার দেশে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যথেষ্ট পরিমাণে ট্রেনের চালক সরবরাহ করা কঠিন হওয়ার কথা না। উপযুক্ত পরিকল্পনা থাকলে ইঞ্জিনও আমদানি করা কঠিন না। যদিও প্রশ্ন আসতেই পারে, এত বছরে কেন বাংলাদেশ রেলওয়ে নিজস্ব প্রযুক্তিতে ইঞ্জিন ও রেল উৎপাদন করতে পারল না।

এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর সেই একটাই। দুর্নীতি। বিদেশ থেকে ইঞ্জিন আমদানি করতে পারলে টাকার নয়ছয় করা যায় অনেক বেশি। আর নিয়মিত সেবাদানের চেয়ে অবকাঠামো নির্মাণে টাকাপয়সার পরিমাণ অনেক বেশি থাকে। সবচেয়ে বড় কথা এগুলোতে ইধার কা মাল উধার করা যায়। বালিশের দাম লাখ টাকা, সুইয়ের দাম হাজার হাজার টাকা দেখিয়ে টাকাপয়সা লোপাট করা যায়।

কেবল যে রেলওয়েতে এই ব্যবস্থা তাই নয়। শিক্ষা খাত বলি, স্বাস্থ্য খাত বলি বা যোগাযোগ, সবখানে একই অবস্থা। বিদ্যালয়ের স্থাপনা বানাতে যতটা উৎসাহ শিক্ষার মান উন্নয়নে ততটা নেই। হাসপাতালের দালান বানাতে যতটা উদ্যোগ নিয়মিত সেবায় তা নেই। আর দেশ জুড়ে দরকারে-বেদরকারে হাজার হাজার পরিত্যক্ত সেতুর ছবি তো আমরা গণমাধ্যমে নিয়মিতই দেখি। কমিশন বাণিজ্যের নির্মম প্রতীক এই ছবিগুলো।

এসব দেখে দেখে অভ্যস্ত জনতা স্বাভাবিকভাবেই সন্দেহ করে যে, এইসব কমিশনখোররা জনগণের ভোগান্তি বাড়াতে যা খুশি করতে পারে। হাজার কোটি টাকার রেল প্রকল্প অকেজো করে রাখতে পারে বাস মালিকদের সঙ্গে যোগসাজশ করে। এর আগে আমরা বছরের পর বছর দেখেছি, সরকারি বিআরটিসি সেবা জনপ্রিয় ও লাভজনক হলেও সেগুলো বেশিদিন টেকে না। রেলের আরও হাজারো অব্যবস্থাপনার সঙ্গে এর কর্র্তৃপক্ষের সঙ্গে বাস মালিকদের যোগসাজশের অভিযোগ তাই উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

জনগণকে দেশের মালিক বলা হলেও, জনগণ বাজারে গিয়ে দেখে দ্রব্যমূল্যের দাম আগুন হয়ে যায় সিন্ডিকেটের কারিকুরিতে, ট্রেনে উঠতে গিয়ে দেখে সেই সেবা বন্ধ, রাস্তায় জ্যামে বসে অবাক বিস্ময়ে দেখে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের প্রকল্পগুলো তার কোনো কাজে আসছে না। কারণ জনগণের সেবা দেওয়ার কোনো দায় বা আর্থিক লাভালাভ নাই। সেতু বানিয়ে, রেলের স্টেশন তৈরি করে, হাসপাতালের দালান ওঠানোর লোভনীয় পয়সা মারা প্রকল্পের বিপরীতে নিয়মিত এদের রক্ষণাবেক্ষণের কাজটা একদমই সাদাসিধা। এখানে পয়সা মারার সুযোগ নেই। তাই এগুলো নিয়ে হেলদোলও নেই।

জনগণ অবাক হয়ে দেখে, সব কিছুর সিন্ডিকেট থাকলেও তার কোনো সিন্ডিকেট নেই।

লেখক: সাংবাদিক ও অনুবাদক

faizbsu002@gmail.com

ভয়েস/আআ

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION